Skip to main content

বন্দী প্রত্যার্পণঃ ভারত বাংলাদেশ প্রসংগ

এক দেশে অপরাধ করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বন্দী প্রত্যার্পণ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একটি দেশের সরকার অন্য কোন সার্বভৌম রাষ্ট্র থেকে ইচ্ছে মতো যে কোন ব্যক্তিকে বন্দি করে নিয়ে আসতে পারে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা থাকতে হয়। এই সমঝোতা কোন সাধারণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে, আবার নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে হস্তান্তরের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানোর মাধ্যমেও হতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোন দেশ অপর দেশের নাগরিককে হস্তান্তর করতে বা না করতে বাধ্য নয়। এ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও অভ্যন্তরীন আইন অনুসারেই এক দেশের নাগরিককে অন্যদেশে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিস্তৃতির ফলে এরূপ বন্দী হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলে ৩২৪ জন ভারতীয় নাগরিক আটক আছেন এবং ভারতের বিভিন্ন জেলে ৫২৬ জন বাংলাদেশি বন্দী আছেন। বাংলাদেশে দেশে বড় বড় অপরাধ সংঘটিত করে অসংখ্য সন্ত্রাসী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। তাদের ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার তালিকা দেয়া হলেও ভারত এ বিষয়ে আশানুরূপ পদক্ষেপ নেয়নি।
১৯৯৭ সালে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তিতে বাংলাদেশের আদালত অবৈধপন্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ ও অবস্থানের অভিযোগে তাকে সাজা দেয়। এরপর থেকে ভারত সরকার অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া, রাজু বড়ুয়া, বিশ্বমোহন দেব বর্মা, চিত্রবান হাজারিকাসহ আরো অনেককে গ্রেপ্তার করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সরকার তা স্বীকার করে নি। এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্য বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
২০১০ সালের ১১ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য সাজাপ্রাপ্ত বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চুক্তিটি র‍্যাটিফাই (অনুস্বাক্ষর) করার মধ্য দিয়ে তা কার্যকরি হয়। চুক্তি অনুযায়ী এই দুই দেশই হস্তান্তরকারী দেশের জেলহাজতে বন্দী থাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে অনুরোধকারী দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারবে।
ভারত-বাংলাদেশ সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী কোনো ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে ওই চুক্তির আওতায় ভারত ফেরত নিতে পারবে। একইভাবে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ভারতীয় আদালতে দণ্ডিত হলে বাংলাদেশ তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যে দেশে গ্রেপ্তার হয়েছে, সে দেশের আদালতে সে সাজাপ্রাপ্ত না হলে তাকে ফেরত দিতে হস্তান্তরকারী দেশ বাধ্য থাকবে না। একই ধরনের বন্দী বিনিময় চুক্তি যদি তৃতীয় কোন দেশের সঙ্গে থাকে, তাহলে ঐ বন্দীকে হস্তান্তরের জন্য ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে।
অন্য দেশে দণ্ডিত আসামিরা নিজ দেশে সাজাভোগ করতে চাইলে তা ভোগ করার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে তাকে নিজ দেশে ফেরার জন্য নিজে বা আইনগত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে যে, যে অপরাধে ওই নাগরিক দণ্ডিত, তা উভয় দেশে দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতে হবে। কিন্তু আবেদনকারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে এ সুযোগ পাবেন না।
তবে এই চুক্তি থেকে বাংলাদেশ আসলে কতটুকু লাভবান হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। চুক্তির শর্তের কারণে বাংলাদেশ ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অধিকাংশকেই ফেরত পাচ্ছে না। কারণ তারা ভারতে পলাতক থাকলেও ভারতের আদালতে তাদের সাজা হয় নি, ফলে বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাবে না। অন্যদিকে ভারত এ চুক্তির মাধ্যমে বহু প্রতীক্ষিত উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত নিতে পারবে। অনেকে মনে করছেন যে মূলত উলফা নেতাসহ অন্যান্য ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে ফেরত নেয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই চুক্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বন্দী হস্তান্তর বিষয়ে সাধারণ আইনটি হচ্ছে বন্দী প্রত্যার্পণ আইন ১৯৭৪ (Extradition Act 1974)। এই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী কোন রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকলেও সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে যে কোন সন্দেহভাজন বা দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বিদেশী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে পারে।
তবে কাউকে বিদেশী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে হলে ৫ ধারায় বর্ণিত শর্ত পূরণ হতে হবে। শর্তগুলো হচ্ছেঃ অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক সঙ্ঘটিত অপরাধটি রাজনৈতিক অপরাধ হবে না; অপরাধটি কমপক্ষে ১২ মাসের কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে; একই অপরাধের জন্য ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আদালতে তার বিচার সম্পন্ন হয় নি; অভিযুক্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে সংঘটিত অন্য কোন অপরাধে অভিযুক্ত বা সাজা ভোগরত নয়; যে অপরাধে তাকে হস্তান্তর করা হবে সেটা ছাড়া অন্য কোন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করার আগে অবশ্যই তার বাংলাদেশে ফিরে আসার আইনগত সুযোগ থাকবে; এবং এরূপ সম্ভাবনা থাকবে না যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিচারের ক্ষেত্রে সে বৈষম্যের শিকার হবে।
৭ ধারা অনু্যায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ১ম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করাতে হবে যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বক্তব্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে অভিযুক্তের বিপক্ষে কোন প্রাইমা ফেসি কেস (আপাতঃ বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ) নেই, তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। অন্যদিকে অপরাধের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট তা উল্লেখ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিবেন, সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে অভিযুক্তকে প্রত্যার্পণ করতে পারে। কিন্তু সরকার যদি তাকে প্রত্যার্পণ না করে ২ মাসের বেশি আটক রাখে তাহলে হাইকোর্ট ঐ ব্যক্তির মুক্তির আদেশ দিতে পারেন।
সাধারণত আন্তর্জাতিক রেওয়াজ অনুযায়ী কোন দেশ নিজ নাগরিককে অন্য কোন রাষ্ট্রের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেই তার অপরাধের বিচার করে। কিন্তু বন্দী প্রত্যার্পণ আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে বিদেশী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। যেমন গত ২০ জুলাই ২০১১ এই আইনের অধীনে মহিউদ্দীন বাবলু নামক এক বাংলাদেশী নাগরিককে যুক্তরাজ্যের হাতে তুলে দেয়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তাকে নিজেদের হেফাজতে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান।

[দৈনিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত, ১৬ আগস্ট ২০১১]

Comments

Popular posts from this blog

সেই ছোটবেলার জিনিসগুলো

ইয়ো-ইয়ো কোকাকোলার সাথে ফ্রি পাওয়া যেতো। আবার আলাদাও কিনতে পাওয়া যেত। নাম ইয়ো-ইয়ো। আঙ্গুলে সুতা আটকে এই জিনিস ঘুরানো হতো, যদিও অতো ভাল পারতাম না। প্রথম দেখি ১৯৯৩ সালের দিকে। টিনের পিস্তল এই রকম টিনের পিস্তলের সাথে ব্যবহারের জন্য বারুদ দেয়া কাগজ পাওয়া যেত। গুলি করলে ফটফট শব্দ হতো। বৈশাখী মেলা থেকে কিনেছিলাম। টিনের জাহাজ পানিতে চলে। এর মধ্যে কেরোসিন তেল রেখে তাতে কাপড়ের সলতে চুবিয়ে তার মাথায় আগুন দিতে হয়। সেই আগুনের ফলে ভটভট শব্দ তুলে পুকুরে জাহাজ চলতে থাকে। ইচ্ছা ছিল বৈশাখী মেলা থেকে এরকম একটা জাহাজ কিনবো, কিন্তু আর কেনা হয় নাই। টাকা ছিল না মনে হয়। ১৯৯৭ সালের কথা। ক্যাসিও ঘড়ি ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষায় রোল নম্বর এক হলে একটা ঘড়ি কিনে দেয়ার কথা ছিল। রোল নম্বর হল তিন। তাতে কি, ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, ঘড়ি না থাকলে সময় দেখবো কীভাবে? ঢাকা থেকে আব্বু নিয়ে আসলেন ক্যাসিও ডিজিটাল ঘড়ি। সারাদিন অকারণে হাত উঁচু করে সময় দেখি। মাঝে মাঝে শুধু ভাব নেয়ার জন্য ঘড়ির দিকে তাকাই। হাত নামানোর পর মনে হয়, আরে কয়টা বাজে সেটাই তো দেখা হয় নাই। সাথে সাথে আরেকবার ঘড়ি দেখি! জ্যামিতি বক্স ...

বই প্রিন্ট করতে গিয়ে

ইবুক পড়ে বাস্তবের বইয়ের মত আরাম পাওয়া যায় না। প্রিন্ট করে পড়তে পারলে ভালো হয়। কিন্তু A4 সাইজের বিশাল কাগজের একদিকের পাতায় যে প্রিন্ট বের হয় তাতে পেপারব্যাক পড়ার মজা পাওয়া যায় না। একটা কাগজে চারটার বদলে মাত্র একটা পৃষ্ঠা প্রিন্ট হওয়ায় কাগজের অপচয় হয়। কাজেই সফট কপি থেকে পেপারব্যাকের মতো প্রিন্টেড বই বানানোর মিশনে নেমে পড়লাম। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে বুকলেট প্রিন্ট নামে একটা অপশন আছে। এর মাধ্যমে একেকটা কাগজে চার পৃষ্ঠা প্রিন্ট হয়, সেগুলোকে মাঝখানে ভাজ করে স্টাপলার করে দিলেই পেপারব্যাকের মত বই হয়ে যায়। কাজটা করতে হলে যে সব ধাপ অনুসরণ করতে হয় তা হলোঃ Page Layout > Margins > Custom Margins > Multiple Pages > Bookfold. তারপর প্রিন্ট দিতে হয়। যদি প্রিন্টার Autoduplex সাপোর্ট না করে তাহলে প্রিন্ট করার সময় Manual Duplex টিক দিতে হবে। অটো ডুপ্লেক্স হলো অটোমেটিক্যালি কাগজের উভয় পাশে প্রিন্ট করার ক্ষমতা। এটা না থাকলে সবগুলো কাগজের এক পাশে প্রিন্ট হওয়ার পর হাত দিয়ে সেগুলোকে উলটে আবার প্রিন্টার দিতে হয়, ফলে অন্য পাশেও প্রিন্ট হয়। নিয়ম মতো সবই করলাম, কিন্তু কাজ হলো না। প্রিন্ট দেয়ার পরেও ...

পলাশ ফুলের বাঁশি

ছোট বেলায় ফাল্গুনের এক বিকেলে একটা ছোট শহরের প্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে দেখি গাছের নিচে সুন্দর কিছু ফুল পড়ে আছে। যার সাথে হাঁটছিলাম সে বললো এর নাম পলাশ ফুল। দেখতে চমৎকার, তবে কোন ঘ্রাণ নেই। কিন্তু ফুলের ভেতরে ধনুকের মত বাঁকানো সাদা টিউবটা বের করে তারও ভিতরের লাল অংশটা ফেলে দিলে এটাকে ঠোঁটে নিয়ে বাঁশির মত বাজানো যায়। এরপর থেকে পলাশ ফুল দেখলেই এরকম বাঁশি বানাতাম। অনেক বছর পরে আজ আরেক ফাল্গুনে এই সব মনে পড়লো আর কি। সেই শৈশব, সেই শান্ত ছোট শহর, সেই পলাশ ফুলের বাঁশি!