এক ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেনি, কিন্তু সরকারের আশঙ্কা যে, সে শিগগিরই কোনো অপরাধ করতে পারে এমন অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে আটক রাখার নামই প্রিভেনটিভ ডিটেনশন বা নিবর্তনমূলক আটক। একজন নাগরিকের স্বাধীনতা হরণ করে তাকে আটক রাখতে হলে অবশ্যই কিছু অনিবার্য কারণ থাকতে হয়। এই আটকাবস্থা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে শাস্তিমূলক আটকাবস্থা যা অপরাধের শাস্তি হিসেবে পর্যাপ্ত প্রমাণসাপেক্ষে বিচারের পর আদালত কর্তৃক আরোপিত হয়। বিচারের উদ্দেশ্যে সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেপ্তারও একই ধরনের আটকাবস্থা। পৃথিবীর সব দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। অপরদিকে একজন মানুষ কোনো অপরাধ করেনি বা তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংঘটনের অভিযোগও নেই, বরং ভবিষ্যতে তিনি অপরাধ করতে পারেন_ এই ধারণার ভিত্তিতে তাকে আটক রাখা হচ্ছে নিবর্তনমূলক আটক। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো দেশের নিজ নাগরিকদের এভাবে বিনা অভিযোগে আটক রাখা কোনো সভ্য আইন-ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম যেখানে প্রিভেনটিভ ডিটেনশন আইনসিদ্ধ।
তবে রাষ্ট্রের অনিবার্য কারণে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। যেমন দেশে যখন যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণজনিত জরুরি অবস্থা বিরাজ করে তখন, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই সম্ভাব্য অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা দরকার, অন্যথায় দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এ কারণে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের আইনই জরুরি অবস্থার সময় সরকারকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু জরুরি অবস্থায় নয়, যে কোনো সময়েই সরকার যে কোনো ব্যক্তিকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের নামে বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখতে পারে।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এ দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের দমন করার জন্য প্রিভেনটিভ ডিটেনশন-সংক্রান্ত আইনের ধারা ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৭৮৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট থেকে শুরু করে ১৯৪৬ সালের বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স পর্যন্ত বিভিন্ন আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে ইংরেজ সরকার এ দেশের অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে কারাগারে আটক রেখেছিল। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের বিধান সংবলিত নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে সেগুলোর অধীনে সরকারবিরোধী নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে আটকের ধারা আরো জোরদার করে। দিনে দিনে এসব কালো আইনের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাই ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের কোনো বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েক বছরের মধ্যেই সরকার জনগণের অধিকারের চাইতে নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া শুরু করে, যার ফলে ১৯৭৩ সালে সংবিধানের ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৩ নাম্বার অনুচ্ছেদে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান যুক্ত করে। জনগণের ইচ্ছার পবিত্র অভিব্যক্তি হিসেবে ১৯৭২ সালে যে চেতনা নিয়ে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে তার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সূচিত হলো। পরিবর্তিত সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাস হয় স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, যা অনেকের কাছে একটি কালো আইন বলে পরিচিত।
বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যদি কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ক্ষতিকর কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে আটক রাখা প্রয়োজন, তাহলে সেই ব্যক্তিকে আটক রাখার নির্দেশ দিতে পারবে। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও অনুরূপ আটকাদেশ দিতে পারবে যা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে বহাল থাকবে। ২(চ) ধারা অনুযায়ী ক্ষতিকর কাজ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, জননিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন কোনো কাজ। এই আইনের ৮(২) ধারা অনুযায়ী আটককৃত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে তার আটকাদেশের ভিত্তি ও কারণ জানাতে হবে যাতে তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে তার লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু ৮(১) ধারায় আবার বলে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন যে কোনো তথ্য প্রকাশ করলে জনস্বার্থ বিঘি্নত হবে, তাহলে তারা সেই তথ্য জানাতে বাধ্য নয়। তার মানে আটককৃত ব্যক্তি তাকে আটক করার কারণ জানতে পারবে কি না তাও সরকারের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এই আইন ব্যবহার করে সরকার ইচ্ছামত যে কোনো নাগরিককে আটক করেই বলতে পারে যে এই ব্যক্তি ক্ষতিকর কাজ করতে পারে মর্মে সরকার সন্তুষ্ট। সব সরকারের আমলেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে অসংখ্য মানুষকে বিনা অপরাধে আটক করে রাখা হচ্ছে।
আইনটির ১০ ধারায় বলা হয়েছে যে আটক করার ১২০ দিনের মধ্যে আটকাদেশটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সামনে পেশ করা হবে। এই বোর্ডের দুইজন সদস্য হবেন হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্য নাগরিক আর অপরজন হবেন একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, যারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। বোর্ডে যে শুনানি হবে তাতে আটক ব্যক্তি কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করতে পারবেন না। আটকের ১৭০ দিনের মধ্যে বোর্ড সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। এই রিপোর্টে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে সরকার যত দিন খুশি ওই ব্যক্তিকে আটক রাখতে পারবে, তবে বোর্ড প্রতি ৬ মাসে একবার করে আটকাদেশটি রিভিউ করবে। এসব রিভিউতে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে একজন ব্যক্তিকে এভাবে সারাজীবন ধরে বিনা বিচারে আটক করে রাখা সম্ভব। ১৩ ধারার অধীনে সরকার যেকোনো সময় আটকাদেশ প্রত্যাহার করতে পারবে।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে যত আটকাদেশ দেয়া হয় তার অধিকাংশকেই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত 'সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার' বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন কমিশনের এক রিপোর্টে দেখা যায় যে শতকরা ৯৯ ভাগ নিবর্তনমূলক আটকই সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু যে সব দরিদ্র মানুষ সুপ্রিমকোর্টে রিট করার সামর্থ্য রাখেন না, তারা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ফাঁদে পড়ে দিনের পর দিন বন্দি থাকছেন।
বিনা অপরাধে নাগরিকদের স্বাধীনতা হরণ করে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বন্দি রাখা মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ ১৯৬৬-এর ৯ নাম্বার অনুচ্ছেদগুলোয় বলা হয়েছে_ 'প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকেই ইচ্ছামত নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা বা আটক রাখা যাবে না। অবৈধ গ্রেপ্তার ও আটকের শিকার প্রত্যেকের রয়েছে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার।' বাংলাদেশ এই দলীলের স্বাক্ষর-দাতা রাষ্ট্র হিসেবে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান বহাল রাখতে পারে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষরবাহী আইনের পুনঃপ্রবর্তন খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকারের উচিত অবিলম্বে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের বিধান রহিত করা। বিশেষ ক্ষমতা আইন যদি রাখতেই হয় তাহলে এর প্রয়োগ শুধু যুদ্ধজনিত জরুরি অবস্থায় সীমিত রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা উচিত। বিনা বিচারে আটক রাখার সর্বোচ্চ মেয়াদ ঠিক করে দেয়া দরকার। আটককৃত ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানানো, আইনজীবীর সাহায্য গ্রহণের সুযোগ এবং অবৈধ আটকাদেশের শিকার হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা রেখে আইনটিকে আরো গণতান্ত্রিক করতে হবে।
তবে রাষ্ট্রের অনিবার্য কারণে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। যেমন দেশে যখন যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণজনিত জরুরি অবস্থা বিরাজ করে তখন, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই সম্ভাব্য অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা দরকার, অন্যথায় দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এ কারণে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের আইনই জরুরি অবস্থার সময় সরকারকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু জরুরি অবস্থায় নয়, যে কোনো সময়েই সরকার যে কোনো ব্যক্তিকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের নামে বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখতে পারে।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এ দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের দমন করার জন্য প্রিভেনটিভ ডিটেনশন-সংক্রান্ত আইনের ধারা ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৭৮৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট থেকে শুরু করে ১৯৪৬ সালের বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স পর্যন্ত বিভিন্ন আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে ইংরেজ সরকার এ দেশের অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে কারাগারে আটক রেখেছিল। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের বিধান সংবলিত নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে সেগুলোর অধীনে সরকারবিরোধী নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে আটকের ধারা আরো জোরদার করে। দিনে দিনে এসব কালো আইনের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাই ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের কোনো বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েক বছরের মধ্যেই সরকার জনগণের অধিকারের চাইতে নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া শুরু করে, যার ফলে ১৯৭৩ সালে সংবিধানের ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৩ নাম্বার অনুচ্ছেদে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান যুক্ত করে। জনগণের ইচ্ছার পবিত্র অভিব্যক্তি হিসেবে ১৯৭২ সালে যে চেতনা নিয়ে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে তার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সূচিত হলো। পরিবর্তিত সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাস হয় স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, যা অনেকের কাছে একটি কালো আইন বলে পরিচিত।
বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যদি কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ক্ষতিকর কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে আটক রাখা প্রয়োজন, তাহলে সেই ব্যক্তিকে আটক রাখার নির্দেশ দিতে পারবে। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও অনুরূপ আটকাদেশ দিতে পারবে যা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে বহাল থাকবে। ২(চ) ধারা অনুযায়ী ক্ষতিকর কাজ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, জননিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন কোনো কাজ। এই আইনের ৮(২) ধারা অনুযায়ী আটককৃত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে তার আটকাদেশের ভিত্তি ও কারণ জানাতে হবে যাতে তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে তার লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু ৮(১) ধারায় আবার বলে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন যে কোনো তথ্য প্রকাশ করলে জনস্বার্থ বিঘি্নত হবে, তাহলে তারা সেই তথ্য জানাতে বাধ্য নয়। তার মানে আটককৃত ব্যক্তি তাকে আটক করার কারণ জানতে পারবে কি না তাও সরকারের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এই আইন ব্যবহার করে সরকার ইচ্ছামত যে কোনো নাগরিককে আটক করেই বলতে পারে যে এই ব্যক্তি ক্ষতিকর কাজ করতে পারে মর্মে সরকার সন্তুষ্ট। সব সরকারের আমলেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে অসংখ্য মানুষকে বিনা অপরাধে আটক করে রাখা হচ্ছে।
আইনটির ১০ ধারায় বলা হয়েছে যে আটক করার ১২০ দিনের মধ্যে আটকাদেশটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সামনে পেশ করা হবে। এই বোর্ডের দুইজন সদস্য হবেন হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্য নাগরিক আর অপরজন হবেন একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, যারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। বোর্ডে যে শুনানি হবে তাতে আটক ব্যক্তি কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করতে পারবেন না। আটকের ১৭০ দিনের মধ্যে বোর্ড সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। এই রিপোর্টে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে সরকার যত দিন খুশি ওই ব্যক্তিকে আটক রাখতে পারবে, তবে বোর্ড প্রতি ৬ মাসে একবার করে আটকাদেশটি রিভিউ করবে। এসব রিভিউতে আটক রাখার পক্ষে মতামত দেয়া হলে একজন ব্যক্তিকে এভাবে সারাজীবন ধরে বিনা বিচারে আটক করে রাখা সম্ভব। ১৩ ধারার অধীনে সরকার যেকোনো সময় আটকাদেশ প্রত্যাহার করতে পারবে।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে যত আটকাদেশ দেয়া হয় তার অধিকাংশকেই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত 'সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার' বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন কমিশনের এক রিপোর্টে দেখা যায় যে শতকরা ৯৯ ভাগ নিবর্তনমূলক আটকই সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু যে সব দরিদ্র মানুষ সুপ্রিমকোর্টে রিট করার সামর্থ্য রাখেন না, তারা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ফাঁদে পড়ে দিনের পর দিন বন্দি থাকছেন।
বিনা অপরাধে নাগরিকদের স্বাধীনতা হরণ করে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বন্দি রাখা মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ ১৯৬৬-এর ৯ নাম্বার অনুচ্ছেদগুলোয় বলা হয়েছে_ 'প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকেই ইচ্ছামত নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা বা আটক রাখা যাবে না। অবৈধ গ্রেপ্তার ও আটকের শিকার প্রত্যেকের রয়েছে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার।' বাংলাদেশ এই দলীলের স্বাক্ষর-দাতা রাষ্ট্র হিসেবে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান বহাল রাখতে পারে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষরবাহী আইনের পুনঃপ্রবর্তন খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকারের উচিত অবিলম্বে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের বিধান রহিত করা। বিশেষ ক্ষমতা আইন যদি রাখতেই হয় তাহলে এর প্রয়োগ শুধু যুদ্ধজনিত জরুরি অবস্থায় সীমিত রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা উচিত। বিনা বিচারে আটক রাখার সর্বোচ্চ মেয়াদ ঠিক করে দেয়া দরকার। আটককৃত ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানানো, আইনজীবীর সাহায্য গ্রহণের সুযোগ এবং অবৈধ আটকাদেশের শিকার হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা রেখে আইনটিকে আরো গণতান্ত্রিক করতে হবে।
[দৈনিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত, ১০ মে ২০১১]
Comments
Post a Comment